Categories
আমার যত কথা

আমার আব্বার সঙ্গীতপ্রীতি, যুগের চাইতে এগিয়ে থাকা এবং Adaptability

The coolest dad who had ever lived.

আজকে হঠাৎ ইসলামী গজল শুনছিলাম। আব্দুল আলীম সাহেবের গাওয়া “আল্লাহু আল্লাহু তুমি জাল্লেজালালু” এই গানটা ইউটিউবে হঠাৎ প্লে হল, হঠাৎ মনে হল ৫ বছর পিছিয়ে গেলাম।

২০২১ সালের এক সকালে আমার আব্বা, মো: শাহ জামাল, আমাদের সবাইকে রেখে না ফেরার দেশে চলে যান। 

মনে হল, আব্বার সংগীতপ্রীতি, প্রযুক্তিগত জ্ঞান, গ্রোথ মাইন্ডসেট এবং যুগের চাইতে এগিয়ে থাকার যে ব্যাপারটা – এটা সম্পর্কে কিছু লেখা যেতে পারে। 

গান বাজনার প্রতি ভালোবাসা

আব্বার গান বাজনার প্রতি ভালবাসা নিশ্চিতভাবেই দাদার কাছ থেকে পাওয়া। আমার দাদা ছিলেন একজন কৃষক। কিন্তু গ্রামের মানুষের ৩০/৪০ বছর আগে বিনোদন ছিল গ্রামের যাত্রাপালা। দাদা পছন্দ করতেন, সেই সাথে নিজেও কিছুটা চেষ্টা করতেন।

সেখান থেকেই শুরু।

ফেজ ১ – ক্যাসেট প্লেয়ার

সময়টা আশির দশকের শেষের দশকের দিকে। ক্যাসেট প্লেয়ারের আবেদন এবং জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। আব্বা ৯০ দশকের শুরুর দিকে একটা বিশাল ক্যাসেট প্লেয়ার সহ রেডিও কিনে ফেললেন, যা এখনও আমাদের বাসার শোভা বাড়াচ্ছে।

Cassette Player
Cassette Player

আব্বা ছিলেন উত্তম কুমারের ফ্যান। উত্তম সুচিত্রার একেক সিনেমা আব্বা কয়েকবার দেখেছেন বলে আমার বিশ্বাস। ক্যাসেট প্লেয়ার কেনার পর আব্বার প্রথম কাজ হল তার সব প্রিয় গায়কের গানের ক্যাসেট কিনে ফেলা, ক্যাসেট দিয়ে রেকর্ড করে পছন্দের প্লেলিস্ট বানানো (নতুনরা যারা বুঝতেসেন না কিভাবে ক্যাসেট এর ফিতা ঘুরিয়ে প্রিয় গান রেকর্ড করা হত, তারা একটু পড়াশোনা করে নিয়েন বিষয়টার উপর) এবং মনের মত গান প্লে করা, কাস্টম রেকর্ডেড ক্যাসেটগুলো থেকে।

দেখতে দেখতে আব্বার একটা বিশাল ক্যাসেট কালেকশন হয়ে গেল। আব্বার কালেকশনের মধ্যে স্থান পেল বিভিন্ন ইসলামিক গজল, কাজী নজরুল ইসলামের নিজের কণ্ঠে গাওয়া বিভিন্ন গান, গজল (রমজানের ওই রোজার শেষের মত গানের অরিজিনাল কপি ছিল আব্বুর কাছে)। এছাড়াও আরও ছিল নামিদামি আর্টিস্টের বিভিন্ন এ্যালবাম

  • নচিকেতা
  • ভূপেন হাজারিকা
  • আশা ভোষলে
  • লতা মঙ্গেশকর
  • মান্না দে
  • শ্রীকান্ত
  • হেমন্ত মুখোপাধ্যায়
  • কিশোর কুমার

এরকম বিভিন্ন আর্টিস্টের হরেক রকম গানের ক্যাসেট ছিল প্রায় ৩০০+। ৯০ দশকে প্রায়ই আমরা শুনতে পেতাম এইসব আর্টিস্টদের গান, ক্যাসেট থেকে।

আমার পছন্দের লাল রঙের ক্যাসেট

আরেকটা প্রিয় ক্যাসেট ছিল আমার। তখনকার টোনাটুনি নামে চমৎকার শিশুতোষ ছড়া সহ একটা ক্যাসেট ছিল আমাদের বাসায়। লাল রঙের ওই ক্যাসেটটা শুনতে শুনতে একদম ঝাঁজরা করে ফেলেছি ছোটকালে। (টোনাটুনির ইউটিউব চ্যানেলে ভিডিও সহ এই কবিতা গুলো আপলোড করা হয়েছে। ভিডিও নতুন বানানো তবে অডিও সেই একদম একই আছে, যেটা নব্বই দশকে রেকর্ড করা)।

Phase 2 – সিডি, এবং ডিজিটাল অডিও

এর আগে একবার লিখেছি কিভাবে কম্পিউটার আমাদের বাসায় এল এবং আমাদের নিত্যদিনের জীবনে ধীরে ধীরে পরিবর্তন করা শুরু করল।

কম্পিউটারের তখন বেসিক ৩ টা কাজ খুব পপুলার।

  • গান শোনা
  • মুভি দেখা / গানের ভিডিও দেখা
  • গেম খেলা

আমার আব্বা খুব দ্রুত কম্পিউটার চালানো শিখে ফেললেন।

(কিভাবে কোন রকম রিসোর্স ছাড়া শিখলেন সেটা এখনো আমার বিস্ময়!)। এরপর তার অন্যতম দুইটা কাজ হল তার টিচার হিসেবে তার সকল নোট/লেকচার নোট কম্পিউটারে কম্পোজ করা এবং গান কালেক্ট করা।

যে আমলের কথা বলছি সে আমলে পুরো এলাকা খুঁজে হাতে গোনা ১/২ টা কম্পিউটার পাওয়া যেতে পারে। সেই আমলে আমার আব্বা এনালগ নোটস থেকে তার পদার্থবিদ্যার যাবতীয় লেকচার নোট, ম্যাথ – সব কম্পিউটারে নিজ হাতে কম্পোজ করে ডিজিটাল কপি স্টোর করেছেন। আমার আব্বা এক্সেলের ও খুব ভাল কাজ পারতেন। বি এ এফ শাহীন কলেজের ক্লাস এসাইন, বিভিন্ন ক্লাসের রুটিনসহ যাবতীয় ইম্পর্টান্ট কাজগুলো আব্বাই করতেন।

যাইহোক, আগের কথাতে ফিরে আসি। পৃথিবীতে এতদিনে আরেক বিপ্লব হয়ে গেছে। এনালগ ক্যাসেটের দিন ফুরিয়ে এসেছে। ক্যাসেটের জায়গা নিয়েছে এনালগ সিডি।

আব্বা চিন্তা করলেন তার আগের ২০০-৩০০ ক্যাসেটকে রিপ্লেস করে কম্পিউটারে নিয়ে আসবেন। যেই ভাবা সেই কাজ। পরবর্তী ১/২ বছরের মধ্যে আব্বার পুরো সিডি কালেকশন চলে My Computer >> Drive F (Audio) তে। (এখনও ড্রাইভের লেটার সহ মনে আছে!)। আব্বার মিউজিক প্লেয়ারও ছিল নির্দিষ্ট। সকলের ফেভারিট উইন্যাম্প ছিল আব্বার প্রিয় অডিও প্লেয়ার। (জেট অডিও নামক একটা প্লেয়ার তখন কিছুটা জনপ্রিয় ছিল, যেটা আমার পছন্দের ছিল)।

যে আমলের কথা বলছি, তখন টেরাবাইটের মতো হার্ড ডিস্ক নেই। আমাদের হার্ড ডিস্ক ছিল ১০ গিগাবাইটের মতো। এই ১০ গিগাবাইটের প্রায় ৩ জিবির বেশি ছিল আব্বার এই গানের কালেকশন। আমাদের স্ট্রিক্ট ইনস্ট্রাকশন ছিল এই ড্রাইভার কোন কিছু যেন কখনো ডিলিট না করা হয়।

যখনই সুযোগ পেতেন, ছুটির দিন সকালে এই গান গুলো প্লে হয়ে যেত আমাদের ওই ঢাউশ সাইজের ক্যাসেট প্লেয়ারের স্পিকারে। সত্যি বলতে আমাদের বেশ ভালোই লাগত। চমৎকার সব গান প্রথম শুনতে পাওয়া এইভাবেই। যেমন ভূপেন হাজারিকার “মানুষ মানুষের জন্য,” মান্না দের “কফি হাউজের আড্ডা”, হেমন্তর “আয় খুকু আয়” কিংবা কাজী নজরুল ইসলামের “রমজানের ওই রোজার শেষে” সবই প্রথমবার শুনেছি বাসার সেই ক্যাসেট প্লেয়ার সাপোর্টেড স্পিকারে, ক্রেডিটস টু মাই ফাদার।

অন দ্য গো মিউজিক

এবার আমার এন্ট্রি ????

ইতিমধ্যে ২টা ট্রানজিশন পার হওয়া আমার আব্বা তখন টুকটাক মোবাইল চালাচ্ছেন। ইন্টারনেট মাত্র শুরু হয়েছে। মিউজিক স্ট্রিমিং তখনও আসে নি, স্পটিফাই টাইপ কিছু এক্সিস্ট করে না।

২০০৬-২০০৮ সালের দিকের কথা বলছি, তখন মোবাইলে গান শোনা একটা “কুল” বিষয়। আব্বা নকিয়া ৬৩০০ ক্লাসিক মোবাইল কিনে ফেললেন। মোবাইলে ছবি তোলা যায়, গান শোনা যায়। আব্বা এরপর তার পুরো মিউজিক কালেকশনের একটা “মিনিমাল” ভার্ষন বানালেন আর মোবাইলে গানগুলো লোড করলেন।

আমাদের দিয়েই লোড করলেন। নকিয়া ফোন পিসিতে কানেক্ট করতে নকিয়া পিসি স্যুট নামক একটা সফটওয়্যার ইউজ করা লাগত তখন। একটু প্যারা খেলেও, জিনিসটা সাকসেসফুলি করতে পারার একটা দারুণ আনন্দও ছিল!

ট্রানজিশন টু ক্লাউড স্ট্রিমিং

একবারে শেষ দশকের কথা বলছি। ১০ বছর আগের কথা। ২০১৫/২০১৬ সাল। ইন্টারনেট দেশে মোটামুটি সহজলভ্য। স্পটিফাই, গুগল প্লে মিউজিক চলে আসছে। আব্বা একদিন হঠাৎ প্রশ্ন করল “ইন্টারনেট থেকে গান প্লে করা যাবে?” আমি বললাম কেন যাবে না।

একটু খুঁজে দেখে, গুগল করে দেখলাম বেশিরভাগ সার্ভিস পেইড। সব মিউজিক সার্ভিসের নিজস্ব লাইব্রেরী, কিন্তু নিজের লাইব্রেরী আপলোড করে স্ট্রিম করা যাবে, এমন ফ্রি সার্ভিস কম।

কিন্তু খুঁজে পেতে একটা অলটারনেটিভ বের করে ফেললাম। তখন মাইক্রোসফ্ট নতুন স্কাইড্রাইভ লঞ্চ করেছে, তাদের আরেকটা মিউজিক সার্ভিসও আছে তখন, গ্রুভ মিউজিক। স্কাইড্রাইভের মিউজিক ফোল্ডারে গান আপলোড করলে গ্রুভ মিউজিক খুব সুন্দরমত স্ট্রিমিং করে। আছে এন্ড্রয়েড এপও। ব্যাস, এরপর আব্বার ফুল কালেকশন চলে এল অনলাইন স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে।

Adaptability বা অভিযোজন করার ক্ষমতা

এত কিছু লেখার অন্যতম মূল উদ্দেশ্য ছিল এইটা বলা যে আমার আব্বা ছিলেন যুগের চাইতে অনেক এগিয়ে। এবং তিনি ছিলেন খুবই এডাপ্টেবল। প্রযুক্তি ব্যবহারে বয়স তার কাছে কোন বাধা হতে পারে নি কখনোই। ৫০ বছরের পর তিনি ওয়ার্ডপ্রেস শিখেছেন, টিচিংবিডি২৪.কম নামের একটি ওয়েবসাইট একা হাতে ১০ বছরের বেশি সময় চালিয়েছেন, ১০০০+ ব্লগ পোস্ট করেছেন, গুগল এডসেন্স থেকে প্রতি মাসে $1000 এর বেশি আয় করেছেন — সবই Adaptability এর কারণে।

He was the coolest dad in town! I miss him everyday.

আজ আব্বুর ৪র্থ মৃত্যুবার্ষিকী।

আজ আব্বুর চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী। চার বছর হয়ে গেল, তিনি চলে গেছেন এই পৃথিবী থেকে, কিন্তু তাঁর উপস্থিতি এখনও আমাদের হৃদয়ে অমলিন। প্রতিটি কাজে আব্বুকে মনে পড়ে।

আব্বার ভালোবাসা, তার দেওয়া শিক্ষা, তার স্মৃতি—সবই আমাদের জীবনে আজীবন পাথেয় হিসেবে থাকবে।

হে আল্লাহ, আমার আব্বুর সকল গুনাহ মাফ করে দিন, তাঁর কবরকে রহমতের বাগানে পরিণত করুন এবং কিয়ামতের দিন তাঁকে আপনার রহমতের ছায়ায় আশ্রয় দিন। আমিন।


Discover more from আমার ঠিকানা...

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

সাইফ দি বস ৭

By সাইফ দি বস ৭

পুরো নাম সাইফ হাসান। ছোটকাল থেকেই প্রযুক্তি, কম্পিউটার সম্পর্কিত বিষয়ে প্রচুর আগ্রহ এবং কৌতূহল। বর্তমানে কর্মরত আছেন উইডেভস এর লিড প্রোডাক্ট ম‍্যানেজার হিসেবে। এর আগে তিনি পপটিন (Poptin) এবং প্রিমিও (Premio) এর প্রোডাক্ট ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেছেন। হিউম্যান সেন্টার্ড ডিজাইন, প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্ট, ডিজাইন থিংকিং, ওয়ার্ডপ্রেস, SaaS, আইওএস, এন্ড্রয়েড, উইন্ডোজসহ টেকনোলজির সাথে যুক্ত থেকে কাজের মধ‍্যে ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করেন।

One Comment

Discover more from আমার ঠিকানা...

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading