এই পোস্টটা লেখার আগে আমি নিজের সম্পর্কে একটু কিছু কথা বলে নিতে চাই আমি সাইফ হাসান, বর্তমানে কর্মরত আছি Poptin নামক একটি বৈদেশিক কোম্পানির প্রোডাক্ট ম্যানেজার হিসেবে। আগে কাজ করেছি বাংলাদেশের একটি স্বনামধন্য সফটওয়্যার কোম্পানির (উইডেভস) প্রোডাক্ট ম্যানেজার হিসেবে। এছাড়াও আমি বাংলাদেশের একটি স্বনামধন্য হোস্টিং এবং ডোমেইন কোম্পানি সহ প্রতিষ্ঠা করেছি যা 2015 সাল থেকে প্রায় 2000+ মানুষকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও আমি কয়েকটি কোম্পানি যারা আমার কাছে তাদের প্রোডাক্ট এবং প্রোডাক্ট মার্কেট ফিট নিয়ে সাহায্য চায় তাদেরকে বিভিন্ন এডভাইস দিয়ে হেল্প করি।
প্রোডাক্ট ম্যানেজার পজিশনটি বাংলাদেশের Software Industry’র জন্য এখনো সেভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। সেই হিসেবে 25 বছর বয়সে একটি বৈশ্বিক কোম্পানির প্রোডাক্ট ম্যানেজার হওয়া এবং প্রায় দশটির বেশি প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ করা আমার জন্য খুবই স্যাটিসফাইং একটি বিষয়, যা আমি প্রতিনিয়ত ও আরো বেশি উপভোগ করছি এবং চেষ্টা করছি আরো কিছু শিখে আরো অনেকদূর যাওয়ার।
শুরুর কথা
স্টিভ জবস এর একটি চমৎকার জনপ্রিয় উক্তি আছে সেটি হচ্ছে যে You can’t connect the dots looking forward. ঠিক একইভাবে আমার কাছে মনে হচ্ছে আমি এখন পুরোনো সে ডটগুলো কানেক্ট করতে পারছি।
আমাদের বাসায় কম্পিউটার এল 2000 সালের দিকে। বেশ মজার একটা কাহিনী আছে। আব্বু ভাইয়াকে বলেছিল সে যদি ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পায় তবে তাকে কম্পিউটার কিনে দিবে। অনেক বাবা-মা ই তার সন্তানদেরকে বিভিন্নভাবে উৎসাহ উদ্দীপনা দেওয়ার জন্য এরকম কথা বলে থাকে। কিন্তু দেখা গেল আমার ভাইয়া আসলেও ৫ম শ্রেণীতে বৃত্তি পেয়ে বসল, এবং শুধু বৃত্তিই না ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেল। যখনকার কথা বলছি সেই আমলে কম্পিউটার পুরো এলাকা তে একটা কিংবা দুইটা। সাইবার ক্যাফে ও সেভাবে আসে নি। আমার আব্বু ছেলেকে দেওয়া কথা রাখলেন। যখন শুনলেন ছেলে বৃত্তি পেয়েছে সাথে সাথেই কম্পিউটার কিনতে রওনা দিয়ে দিলেন এবং বাসায় এলেন নতুন একটা কম্পিউটার নিয়ে।
যে আমলের কথা বলছি তখন সত্যিই তখন ৭০-৮০ হাজার টাকা অনেক টাকা। আমার আব্বু ৭০-৭৫ হাজার টাকা খরচ করে বাসায় কম্পিউটার এনে ফেলার মত দুঃসাহস করে ফেললেন এবং এইটাই হল আমাদের গল্পের প্রথম একটা ডট। আমরা যে খুব উচ্চবিত্ত এমনও না। আব্বু তবুও মানুষ জনের কাছে ধার করে এবং হাউজ লোন নিয়ে বাড়ি করে ফেলেছেন যা পরবর্তীতে ধীরে ধীরে সব শোধ করেন পরবর্তী প্রায় ২৩ বছর ধরে। (১৯৯৫ সাল থেকে ২০১৮)
কম্পিউটার তো বাসায় এল কিন্তু তখন এমন এক সময় কম্পিউটার থাকলেও কম্পিউটার ব্যবহার কিভাবে করতে হয় আমরা কেউ জানি না। মাউস কিবোর্ড দিয়ে কি করে আমরা কেউ কিছু জানি না। বিশাল এক বিপদে পড়লাম আমরা, কারণ আশেপাশে কেউই কম্পিউটার বুঝে না। আমরাও বুঝি না। ম্যানুয়াল পড়ে কোন কিছু শেখার মত বয়স ও আমাদের কারো হয় নি। আমি নিতান্তই তখন শিশু।
মাউস কিবোর্ড দিয়ে কি করে আমরা কেউ কিছু জানি না। বিশাল এক বিপদে পড়লাম আমরা সবাই, কারণ কেউ কম্পিউটার বুঝি না।
এর মধ্যে আব্বু তার এক পুরাতন ছাত্র যোগাড় করে ফেললেন যে মোটামুটি কম্পিউটার চালাতে পারে। তার কাছে তখন শুরু হল আমাদের ট্রেনিং। আমাদের বলতে উনি এসে আব্বু কে শেখায় আর আমরা পাশে বসে থেকে এই জাদুর বাক্স দিয়ে কি হচ্ছে সেটা বোঝার চেষ্টা করি। এভাবে ১৫-২০ দিনের মধ্যে আব্বু মোটামুটি কম্পিউটার এর ব্যাসিক শিখে ফেলল। এরপর ভাইয়া শিখে ফেলল। ভাইয়া কে অনুকরণ করতে করতে আমিও কম্পিউটার অন/অফ করা আর My Computer e ঢুকে ফোল্ডার এক্সপ্লোর করা শিখে গেলাম।
আস্তে আস্তে আব্বু কম্পিউটারে আরো অনেক এক্সপার্ট হয়ে গেলেন। মাইক্রোসফট অফিস ওয়ার্ড এবং এক্সেল এ আব্বু এমন সব ফর্মুলা লিখতে পারতেন যা এখনো আমি সত্যিকার পারি না। আমার আব্বু পেশায় একজন পদার্থ বিজ্ঞানের কলেজ শিক্ষক ছিলেন। তিনি কম্পিউটার দিয়ে তার পুরো নোট টা করে ফেললেন। সেই আমলে পড়াশোনার জন্যে অন্য কোন শিক্ষক কম্পিউটারে কম্পোজ করা নোট দিয়েছেন বলে মনে পড়ে না। [পরবর্তীতে তিনি ওয়ার্ডপ্রেস এও দক্ষ হয় উঠেন আমাদের সহযোগিতায় এবং স্টুডেন্টদের জন্যে প্রচুর ডিজিটাল কনটেন্ট বানান। প্রায় ২০০০+ বেশি পোস্ট রয়েছে এখনও teachingbd24.com এ, যেখানে পদার্থবিজ্ঞান সহ বিভিন্ন নোট, কোশ্চেন পেপার, মক টেস্ট, MCQ এগুলো রয়েছে।]
৪-৫ বছরের মধ্যে আমি আর ভাইয়া মোটামুটি কম্পিউটার এ বেশ এক্সপার্ট হলে গেলাম। এক্সপার্ট বলতে কম্পিউটারের কোথায় কি আছে, কন্ট্রোল প্যানেল এর কোন অপশনে কি আছে, Microsoft Paint e ছবি এঁকে প্রিন্ট করে ফেলা, গেম ইনস্টল করা, গেম ক্রাক করা সফ্টওয়ার ইনস্টল করা এগুলা সব ই আমরা শিখে ফেললাম আস্তে আস্তে।
Me with my father and mother on my Graduation day
মজার ব্যাপার হল যেই লিনাক্স শেল আমাদের ছেলেমেয়েরা ইউনিভার্সিটি ২য় বর্ষের আগে চোখে দেখে না, আমার আব্বু নিজে ঘেঁটে ঘেঁটে CD, Partition, Format, ইত্যাদি কমান্ড দিয়ে উইন্ডোজ শেল থেকে উইন্ডোজ ইনস্টল দিতে পারতেন। আমাদের বাসায় একটা নিয়ম ও ছিল। যে কমপিউটার নষ্ট করবে তাকে ঠিক করতে হবে। এমন যদি হতো যে কম্পিউটার ভাইরাস infected তাহলে আমাদেরকেই MS DOS থেকে উইন্ডোজ ৯৮ কিংবা এক্সপি সেটাপ করতে হত। এর জন্যে আব্বু চমৎকার একটা বাংলা টিউটোরিয়াল লিখে কমান্ড গুলো প্রিন্ট করে রেখেছিলেন যাতে আমরা সহজে কমান্ডগুলো দেখে লিখতে পারি।
এসবই ইন্টারনেট বিপ্লবের আগের কথা। এরপর ২০০৮ সালে আমাদের বাসায় ইন্টারনেট আসল। ভাইয়ার জোরাজুরিতে আব্বু রাজি হলেন। ২০০৮ সাল থেকে আমরা বাসায় ইন্টারনেট চালাচ্ছি জিনিসটা কিন্তু কম কথা নয়! বেশিরভাগ বাবা মা যখন ইন্টারনেট বিষয়ে জানেন ই না, আমার আব্বু বাসায় ইন্টারনেট এনে ফেললেন ভাইয়ার সহযোগীতায়। এটিও ছিল আমার আব্বুর দূরদৃষ্টির প্রমাণ। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে পরবর্তী বিপ্লবটা কম্পিউটার বা প্রযুক্তবিষয়ক দিকেই হবে। এটি মনে করেন আমাদের গল্পের দ্বিতীয় ডট।
ইন্টারনেট যখন চলে আসল আমি তখন রোজ দিনে ৬/৭ ঘণ্টা কম্পিউটারের সামনে কাটাই। প্রচুর ওয়েবসাইট ঘোরাঘুরি করি বড় বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান যাদের খবর শুধু সংবাপত্রগুলোতে দেখতাম তাদের ওয়েবসাইট ঘুরি। নতুন নতুন সফটওয়্যার এক্সপ্লোর করি। ২০০৮-২০১২ সাল পর্যন্ত প্রচুর website এবং সফ্টওয়ার সম্পর্কে আইডিয়া নেওয়ার ফলে আমার মধ্যে আস্তে আস্তে একজন ইউজার সেন্ট্রিক মাইন্ডসেট গড়ে ওঠে যা পরবর্তীতে আমাকে প্রচণ্ড হেল্প করে এবং অন্যান্যদের তুলনায় এগিয়ে রাখে। এটি আমাদের গল্পের তৃতীয় ডট।
ফাস্ট ফরওয়ার্ড করে ২০১৯ সালে চলে আসি। AIUB নামক একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমি তখন Software Engineering এ পড়াশোনা করছি এবং এ সময় আমার সুযোগ হয়ে গেল বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা কর্মক্ষেত্র weDevs এ কাজ করার। weDevs এ জয়েন করার ৬ মাসের মধ্যে weDevs ফ্যামিলি বুঝতে পারে (এবং আমিও কতৃপক্ষকে অবহিত করি) যে আমি মূলত প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্টে কাজ করতে আগ্রহী। এবং তার কিছুদিন পরেই আমি প্রোডাক্ট ম্যানেজার হিসেবে weDevs এর প্রথম এমপ্লি হয়ে কাজ শুরু করি এবং পরবর্তীতে ২০২১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত টানা ফুলটাইম তাদের সাথে কাজ করি। এবছর শুরুর দিকে আমি একটি ইন্টারন্যাশনাল সফটওয়্যার কোম্পানিতে কাজ করার সুযোগ পাই এবং তা গ্রহণ করি।
কানেক্টিং দ্যা ডটস
যখন আমি ২০২১ সালে পিছনে ফিরে তাকাই তখন দেখতে পাই আমার আব্বু যদি সাহস করে সেদিন কম্পিউটার না কিনতেন, আমাদের জন্যে সেই ২০০৮ সালে ইন্টারনেট এর ব্যবস্থা না করতেন আর আমি যদি প্রায় ৪ বছর ইন্টারনেট ঘুরে ঘুরে সফটওয়ারের জগতে ডুবে না যেতাম হয়ত আমি আজ যে জায়গাতে কাজ করছি তা কোনভাবেই সম্ভব হত না।
আমার আব্বু মস্তিষ্ক এর hemorrhage স্ট্রোক করে ডিপ কোমাতে ছিলেন প্রায় ৩ মাস। এই ৩ মাস তিনি এক প্রকার সেন্সলেস অবস্থাতে ছিলেন এবং এরপর গত মার্চ মাসের ২০ তারিখে এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। আমার আব্বু কখনোই তার নিজের সিদ্ধান্ত আমাদের উপর চাপিয়ে দেন নি। আমাদের শিক্ষা এবং নৈতিকতার এক অসাধারণ শিক্ষা দিয়ে গেছেন।
আজ যখন পিছনে ফিরে তাকাই দেখতে পাই কত সংগ্রাম করে আমাদের বড় করেছেন এবং এমনসব প্রিভিলেজ সময়ের আগেই দিয়ে গেছেন যার জন্যে আমি আজ ভাল কিছু করে খেয়ে পরে আছি।
আমার আব্বুর জন্যে সবাই দোআ করবেন। আপনাদের যাদের বাবা মা বেঁচে আছেন সময় থাকতে বলে ফেলুন আপনি তাদের কতটা ভালোবাসেন। হয়ত পরবর্তীতে এ সময় আর নাও পেতে পারেন।
Discover more from আমার ঠিকানা...
Subscribe to get the latest posts sent to your email.
Add your first comment to this post